রাখাইনে নতুন রাষ্ট্র গঠিত হলে কতটা সংকটে পড়বে বাংলাদেশ!
প্রকাশ: ০৪ জানুয়ারী ২০২৫, ০৯:৫৪ অপরাহ্ন
রাখাইনে নতুন রাষ্ট্র গঠিত হলে কতটা সংকটে পড়বে বাংলাদেশ!
চলতি মাসেই সরকারি বাহিনীকে পরাজিত করে রাখাইনে আশি শতাংশের বেশি অঞ্চলের দখল নিয়েছে রাজ্যটির সশস্ত্র বিদ্রোহী বাহিনী আরাকান আর্মি। ফলে কক্সবাজার সীমান্তের ওপাড়ে তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এখন অনেকটাই নিশ্চিত। এমন ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ও তার সীমান্তরক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকট হিসেব উপস্থিত হতে পারে ।
রোহিঙ্গা ও আরাকান আর্মির মধ্যে বিরোধী বহু পুরানো। এছাড়া গত কয়েক মাস আগে চলা সংঘাতে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বাহিনীর পক্ষে রাখাইনের বেশ কিছু রোহিঙ্গা অংশগ্রহণ করে। ফলে রাখাইনকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে আরাকান আর্মি সরকার গঠন করলে সীমান্তের ওপাড়ে থাকা ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গার বাংলাদেশে ঢল নামারও শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে অবস্থান নেয়া দশ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার ফেরত যাওয়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
সীমান্ত থাকা প্রতিবেশি মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও বাণিজিক সম্পর্ক একেবারেই সীমিত। স্পর্শকাতর রোহিঙ্গা ইস্যু, সমুদ্রসীমা বিরোধ মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর বাংলাদেশের আকাশ ও সমুদ্রসীমা লঙ্ঘন, পাবর্ত্য অঞ্চলকে নিজেদের বলে দাবী করার মতো বহু কারণে দুই দেশের সম্পর্কও বরফ শীতল। এছাড়া নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে কার্যত হাত গুটিয়ে নিয়েছে ভারত ও চীন। ফলে শরনার্থী রোহিঙ্গারা নতুন সংকট হিসেবে আর্বিভূত হতে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, দেড় দশক আগে ২০০৯ সালের ১০ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয় এএ হল ইউনাইটেড লীগ অফ আরাকান (ইউএলএ) এর সামরিক শাখা আরাকার আর্মির। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের দাবিতে তারা তাদের কার্যক্রম শুরু করে। রাখাইন নৃগোষ্ঠীর (আরাকানি) বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের এই সংগঠন নিজেদের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে সামনে রেখে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় গোষ্ঠীটি। আর প্রতিষ্ঠার মাত্র দেড় দশকের কম সময়ে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীকে পরাজিত করে রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে তারা। তাই দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এখন অনেকটাই নিশ্চিত।
এর আগে মিয়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তার তেজগাঁও কার্যালয়ে সাক্ষাৎ করেন জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার টমাস অ্যান্ড্রুজ। প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারের রাখাইনে বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর জন্য একটি ‘নিরাপদ অঞ্চল’ তৈরির আহ্বান রেখে বলেছেন, এই উদ্যোগ সংকট সমাধানের প্রধান উপায় হতে পারে। অ্যান্ড্রুজ গত মাসে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকের ফাঁকে উত্থাপিত রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে তিন দফা প্রস্তাব দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, রাখাইন রাজ্যের সহিংসতা একটি ‘গভীর সংকট’ সৃষ্টি করেছে এবং বাস্তুচ্যুত ও ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য মানবিক সহায়তা জরুরিভাবে প্রয়োজন, বিশেষ করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য। রাখাইন রাজ্যসহ মিয়ানমারে কমপক্ষে ৩১ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যেখানে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলি বছরের পর বছর ধরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা রাখাইন থেকে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। যদিও বাংলাদেশ ইতোমধ্যে কক্সবাজারে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। ২০১৭ সালের অগাস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘জাতিগত নির্মূল’ অভিযান চালায় দেশটির সেনাবাহিনী ও স্থানীয় উগ্রপন্থি বৌদ্ধরা। গ্রামসুদ্ধ জ্বালিয়ে দেওয়া, ফসলের ক্ষেত পুড়িয়ে দেওয়া, হামলা, লুটপাট ও ধর্ষণের মত জঘন্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের মুখে জীবন বাঁচাতে দলে দলে রোহিঙ্গারা পালিয়ে আসে বাংলাদেশ, যার সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১১ লাখ। এই বিপুল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আশ্রয় হয় কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলায়। তাদের আবাসনে হুমকির মুখে পড়েছে জেলাটি জীব-প্রাণী ও পাহাড়ের বৈচিত্র্য।
রোহিঙ্গাদের জন্য ‘নিরাপদ অঞ্চল’ কোথায় হবে?
রোহিঙ্গাদের জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নিরাপদ অঞ্চল গঠনের কথা অনেক দিন ধরেই আলোচনায় আছে। বিশেষ করে গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণের পরে ড. মুহাম্মদ ইউনূসও এই প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল কোথায় হবে? মিয়ানমারে, বাংলাদেশে নাকি অন্য কোনো দেশে? যে মিয়ানমার সরকারের জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা দলে দলে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে, সেই মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তুলতে জায়গা দেবে—এটি ভাবার কোনো কারণ নেই। উপরন্তু মিয়ানমারে চীন ও ভারতের বড় বিনিয়োগ থাকায় এবং রোহিঙ্গাদের ধর্মীয় পরিচয় মুসলিম হওয়ায় তাদের সংকট সমাধানে পশ্চিমা বিশ্বও খুব বেশি তৎপর নয়। সুতরাং মিয়ানমার যদি রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তুলতে জায়গা ও সহযোগিতা না দেয়, তাহলে নিরাপদ অঞ্চল কোথায় হবে? বাংলাদেশে? বাংলাদেশ এরইমধ্যে রোহিঙ্গাদের ভারে ন্যুব্জ। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা এখন এ দেশে। বাংলাদেশ কেন মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংকটের ভিকটিম হবে? অতএব বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলাও বাস্তবসম্মত নয়। রোহিঙ্গাদের মূল আবাসন মিয়ানমারের যে রাখাইন রাজ্যে, তার গুরুত্বপূর্ণ শহর মংডু এবং বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পরে এবার রাখাইনের আন শহরটিও আরাকান আর্মি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বিরোধ পুরনো। সুতরাং পুরো রাখাইনে আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে রোহিঙ্গারা আরও সংকটে পড়বে এবং সেখানেও হয়তো তাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। নিরাপদ অঞ্চল এমন একটি নির্ধারিত ভৌগোলিক এলাকা, যেখানে আন্তর্জাতিক সংস্থার তত্ত্বাবধানে বাসিন্দাদের জীবন ও মানবাধিকার সুরক্ষিত থাকে। যেখানে সহিংসতা, নির্যাতন বা দমন-পীড়ন থেকে মানুষকে রক্ষা করা হয় এবং শরণার্থীরা নিরাপদে বসবাস ও পুনর্বাসনের সুযোগ পায়। সেই অর্থে বাংলাদেশের কক্সবাজার ও ভাসানচরের যেসব ক্যাম্পে রোহিঙ্গারা বসবাস করছেন, সেগুলো এক অর্থে নিরাপদ অঞ্চল। পার্থক্য হলো সেখানে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার তত্ত্বাবধান ও সহায়তা থাকলেও শান্তিরক্ষা বাহিনী নেই।
ড. ইউনূস কি পারবেন?
ড. ইউনূস অনেক দিন ধরেই রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলার কথা বলছেন। সবশেষ গত ১৮ ডিসেম্বর মিশরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত ডি-৮ সম্মেলনের ফাঁকে মালয়েশিয়ার উচ্চশিক্ষাবিষয়ক মন্ত্রী ড. জাম্বরি আব্দুল কাদিরের সঙ্গে আলাপকালেও তিনি রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলার বিষয়ে তার সমর্থনের কথা জানান এবং এই ইস্যুতে তিনি মালয়েশিয়ারও সমর্থন চান। এর আগে গত ৪ সেপ্টেম্বর রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ড. ইউনূসের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়। এতে মিয়ানমার বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত জুলি বিশপ, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) ফিলিপ্পো গ্রান্ডি ও পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এই বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে ড. ইউনূস বলেন, 'আমাদের সতর্ক হতে হবে, এই সংকটের সমাধান না হলে শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র অঞ্চল সমস্যায় পড়বে।' তিনি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নতুন করে ভাবার প্রস্তাব দেন। বলেন, 'প্রথমত, আমরা চাই জাতিসংঘ মহাসচিব যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সবপক্ষের উপস্থিতিতে একটি সম্মেলনের আয়োজন করুক। সম্মেলনে সংকটের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনাপূর্বক নতুন এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সমাধানের উপায় কী হতে পারে, তেমন প্রস্তাব আসতে হবে।' তিনি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করারও তাগিদ দেন।
সমাধান কী?
স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় সমস্যার সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধান হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেওয়া। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মিয়ানমার সরকার সেটি করবে না। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে তাদের মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে যে মিয়ানমারকে বাধ্য করা যাবে, তারও সম্ভাবনা কম। কেননা এই চেষ্টা বহুবার হয়েছে। খোদ জাতিসংঘও এই ইস্যুতে নানা চেষ্টা চালিয়েছে। তাতে সমস্যা কোনো সমাধান হয়নি। বরং এখনও মাঝেমধ্যেই মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। অর্থাৎ মিয়ানমার রাখাইন অঞ্চলে এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করে রাখে, যাতে সেখানে কোনোভাবেই এই মুসলিম জনগোষ্ঠী শান্তিতে বসবাস করতে না পারে এবং জীবন নিয়ে পালিয়ে যায়। মিয়ানমার সরকার কেন এটি পারে বা কেন তারা আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করেও টিকে থাকে—তা নিয়ে নানা আলোচনা আছে। কিংবা জাতিসংঘ অথবা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক ফোরাম কেন তাদেরকে বাধ্য করতে পারে না, সেই আলোচনাও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এমন বাস্তবতায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বাইরে তৃতীয় কোনো দেশ বা দেশগুলোতে পুনর্বাসনই একটি উত্তম বিকল্প হতে পারে বলে অনেক দিন ধরেই বলা হচ্ছে। কেননা বাংলাদেশ যে অনন্তকাল ১২-১৩ লাখ বিদেশিকে আশ্রয় দিয়ে রাখবে, সেটি বাস্তবসম্মত নয়। তাহলে এই বিশাল জনগোষ্ঠী কোথায় যাবে বা তাদের ভবিষ্যৎ কী—সেটি অন্তত মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে একটি বিরাট প্রশ্ন।
কেবল অভ্যন্তরীণ সামরিক জয়-পরাজয় নয়; রাখাইন রয়েছে গুরুতর ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের কেন্দ্রবিন্দুতে। রাজ্যটি ঘিরে চীন ও ভারতের রয়েছে বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক কৌশলগত স্বার্থ ও বিপুল বিনিয়োগ। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র যে ‘বার্মা অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করে, এর কেন্দ্রেও রাখাইন। তিন পক্ষের কেউই চাইছে না রাখাইনের স্থিতাবস্থা বিনষ্ট হোক। সামরিক দিক থেকেও মিয়ানমারের জান্তা সহজে হাল ছেড়ে নাও দিতে পারে। রাখাইনের বাইরেও এমন অনেক নজির রয়েছে, বিদ্রোহীরা কোনো এলাকা দখলে নিলেও সামরিক জান্তা মাসের পর মাস বিমান হামলা চালিয়ে গেছে। এমন নজিরও কম নয়, দখলে রাখতে না পেরে কোনো জনপদকে নির্বিচার বিমান হামলায় ধ্বংস্তূপে পরিণত করেছে। এ অবস্থায় আরেকজন পর্যবেক্ষক আমাকে বলেছেন, রাখাইন স্বাধীনতা ঘোষণা করবে বা করতে পারবে কিনা, সেজন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে।
এখানেই দ্বিতীয় প্রশ্নটি, রাখাইনের স্বাধীনতা-উন্মুখ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের কী করণীয়? চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, লাওস যদিও মিয়ানমারের প্রতিবেশী, রাখাইনের সঙ্গে সরাসরি সীমান্ত রয়েছে কেবল বাংলাদেশের। নিজেদের স্বাধীনতার পর এই প্রথম পাশে আরেকটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। ভাবতে হবে, ১৫ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর প্রত্যাবর্তনের কথাও। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা সমর্থনের মতো নিছক নীতিগত অবস্থান এখানে যথেষ্ট নয়। জানা গেছে, রাখাইনকে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণার সম্ভাবনাকে মাথায় রেখে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করেছে ভারত চীন আমেরিকার মতো দেশগুলো। এতে প্রশ্ন উঠেছে, ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কি নতুন সংকটে পড়তে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
এদিকে ভৌগলিকভাবে রাখাইনের অবস্থান ও সম্পদ চীন ও ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই রাখাইনকে নিজেদের বলয়ে রাখতে এশিয়ার দুই পরাশক্তি ভারত ও চীন এর মধ্যেই তাদের জাল বিস্তার করে ফেলেছে। জানা গেছে, রাখাইনে আছে এই দুই দেশের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ।
চীন রাখাইনের চকভিউতে গড়ে তুলেছে গভীর সমুদ্রবন্দর। বঙ্গপোসাগরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলায় রাখাইনের এই বন্দর চীনের মহাস্ত্র। এছাড়া এই বন্দর থেকেই সরাসরি গ্যাস যায় চীনে। দেশটির বেল্টেন্ড রোড ইনেসিয়েটিভ বাস্তবায়ন এবং মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকায় তেল-গ্যাস পাঠানোর বিকল্প ও সহজ পথও এই অঞ্চলকে ঘিরে। এছাড়া মিয়ানমারের ইরাবতী নদীতে চীনের ১৩ হাজার মেগাওয়াটের এক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প রয়েছে। অন্যদিকে ভারতের জন্য রাখাইন মহাগুরুত্বপূর্ণ। কালাদান মেগা প্রজেক্টের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বাইপাস করে সেভেন সিস্টার ও কলকাতার মধ্যে ভারতের যোগাযোগ সহজ করতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে ভারত। এছাড়া সেভেন সিন্টারকে চীনের বিচ্ছিন্নকরণের হুমকি মোকাবিলায়ও রাখাইন ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদেশগুলোর কাছেও রাখাইন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান নিয়ে আছে। এশিয়ার এই অঞ্চলের প্রভাব ও বানিজ্যিক পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে । মিয়ানমারের সরকার ও আরাকান আর্মি দুপক্ষের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক আছে ভারত ও চীনের। নতুন রাষ্ট্র গঠন হলেও এই দুই দেশের তেমন প্রভাব পড়বে না। তবে নতুন রাষ্ট্র গঠিত হলে চাপ বাড়বে বাংলাদেশের।
এছাড়া নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে কার্যত হাত গুটিয়ে নিয়েছে ভারত ও চীন। ফলে শরনার্থী রোহিঙ্গারা নতুন সংকট হিসেবে আর্বিভূত হতে যাচ্ছে। জানা গেছে, রোহিঙ্গা ও আরাকান আর্মির মধ্যে বিরোধী বহু পুরানো। এছাড়া গত কয়েক মাস আগে চলা সংঘাতে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বাহিনীর পক্ষে রাখাইনের বেশ কিছু রোহিঙ্গা অংশগ্রহণ করে। ফলে রাখাইনকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে আরাকান আর্মি সরকার গঠন করলে সীমান্তের ওপাড়ে থাকা ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গার বাংলাদেশে ঢল নামারও শঙ্কা করছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো।