শিরোনাম

ভিডিও

বায়তুল মোকাররমের টয়লেটে দম বন্ধের উপক্রম

 প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারী ২০২৫, ১০:০১ অপরাহ্ন

যত্নের অভাবে জরাজীর্ণ জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের টয়লেট ও অজুখানায় গেলে যে কারো দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হবে। টয়লেটগুলো চরম অস্বাস্থ্যকর। দুর্গন্ধে আশপাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়াও কষ্টকর। বেশির ভাগই ব্যবহার অনুপযোগী। অধিকাংশের দরজা নেই বা থাকলেও ভাঙা। দরজা থাকলেও নেই ছিটকিনি। কমোডগুলোও ভেঙে গেছে। পানির ট্যাপ আছে তো বদনা নেই, আবার বদনা আছে তো ট্যাপ নেই। কমোড ভর্তি হয়ে আছে ময়লায়। টিস্যু ও হ্যান্ড ওয়াশের কোনো ব্যবস্থা তো নেই-ই। টয়লেটগুলোর লাগোয়া অজুখানাতেও নেই পরিচ্ছন্নতার কোনো বালাই। পড়ে থাকে খাদ্যের উচ্ছিষ্ট-ময়লা। অজুখানার অনেক ট্যাপই আবার ভাঙা অথবা অকেজো। সুতলি দিয়ে বাঁধা ট্যাপও রয়েছে। দুর্গন্ধ আর অপরিচ্ছন্নতার মধ্যেই দম বন্ধ করে অজু করে নামাজে যেতে হচ্ছে মুসল্লিদের। বায়তুল মোকাররম মসজিদের নিচতলার পূর্ব ও দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে আলাদা দু’টি শৌচাগার ও অজুখানা রয়েছে। এ ছাড়া দ্বিতীয়তলায় মসজিদের পূর্ব দিকে উত্তর ও দক্ষিণ পাশে রয়েছে আলাদা দু’টি অজুখানা। নিচতলায় মার্কেটের বিভিন্ন দোকানের পাশে স্থাপিত শৌচাগার ও অজুখানা দু’টির মধ্যে পূর্ব পাশেরটির অবস্থা বেশি খারাপ। দু’টি শৌচাগার মিলে ১৫০টির মতো টয়লেট রয়েছে। দক্ষিণ পাশের টয়লেট সৌদি অর্থায়নে বায়তুল মোকাররমের সংস্কার কাজের সাথে ২০১০ সালে নির্মিত হয়। সেখানকার অজুখানার ট্যাপগুলো অত্যাধুনিক ছিল। কিন্তু এখন সেগুলোর বেশির ভাগই ভাঙা অথবা পরে সাধারণ ট্যাপ লাগানো হয়েছে। তবে টয়লেটগুলোর অবস্থা পূর্ব পাশের তুলনায় কম হলেও চরম অস্বাস্থ্যকর। এখানে ব্যবহার অনুপোযোগী অনেকগুলো টয়লেট দেখা গেছে। দুয়েকটির দরজায় বাঁশ রাখা আছে। নিচের দু’টিসহ চারটি অজুখানারই অনেকগুলো ট্যাপ ভাঙা এবং কিছু ট্যাপ সুতলি দিয়ে বাঁধাও লক্ষ্য করা যায়। পূর্বপাশের অজুখানায় অজু করে বের হয়ে মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন আব্দুল মজিদ নামে একজন। টয়লেটের অবস্থার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, দেখতেই পাচ্ছেন কী অবস্থা। এই পর্যন্ত দুর্গন্ধ আসছে। এটি জাতীয় মসজিদের টয়লেট ভাবা যায়? মসজিদে একসঙ্গে ৪৫০ জন মুসল্লির ওজু করার ব্যবস্থা রয়েছে। মসজিদের বিভিন্ন স্থানে ৬১টি প্রস্রাবখানা ও ৯৬টি টয়লেট রয়েছে। তবে বাস্তবে মসজিদটির বেশিরভাগ টয়লেট ব্যবহার উপযোগী নয়। কোনও কোনও টয়লেট এতই নোংরা যে দুর্গন্ধে পাশ দিয়ে চলাচল করাও কঠিন। কোনও কোনও টয়লেটে কমোড ভাঙা, নেই পানির ট্যাপ। অজুখানাগুলোও অপরিচ্ছন্ন। মসজিদটিতে ৬৮ মিটার উচ্চতার একটি মিনার রয়েছে। এছাড়া গম্বুজ রয়েছে তিনটি। মোট এক লাখ ২৮ হাজার ৯০০ বর্গফুট আয়তনের রয়েছে পার্কিং ব্যবস্থা। এর মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে ৮৮ হাজার ৯০০ বর্গফুট, উত্তর পূর্ব দিকে ৪০ হাজার বর্গফুটের পার্কিং ব্যবস্থা। মসজিদটিতে পরিচালনা ও নামাজ পড়ানোর জন্য ১ জন কর্মকর্তা, ১ জন খতিব, ৪ জন ইমাম, ৩ জন মুয়াজ্জিন এবং ২২ জন খাদেম ও কর্মচারী রয়েছেন। সৌদি আরবের অর্থায়নে ২০০০ সালে বায়তুল মোকাররম মসজিদের সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্যবৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়। সে বছর ২৫ ফেব্রুয়ারি মূল মসজিদের দক্ষিণাংশের সম্প্রসারণ, নান্দনিক মিনার নির্মাণ, পূর্ব চত্বরের খোলা অংশের আচ্ছাদিতকরণ, বেজমেন্ট কারপার্ক নির্মাণ, ওজু খানা ও টয়লেট নির্মাণ দক্ষিণ দিকে সুউচ্চ গেট নির্মাণ প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। কাজ শেষে ২০১০ সালের ২৯ জানুয়ারি উদ্বোধন হয়। তবে সম্প্রসারণ-সৌন্দর্যবৃদ্ধি করা হলেও অযত্নে অবহেলায় জরাজীর্ণ অবস্থায় সৃষ্টি হয়েছে। বায়তুল মোকাররমে মসজিদে থাকা দোকান নিয়ে সবচেয়ে বেশি আপত্তি মুসল্লিদের। মার্কেটের কারণে মসজিদের চারপাশ জুড়ে হট্টগোল। বাইরে থেকে মসজিদের চেয়ে মার্কেটই বেশি নজরে আসে। মসজিদটিতে ৮৫৫টি দোকান রয়েছে। এসব খাতে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে বায়তুল মোকাররমের আয় দুই কোটি ৪৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা। বায়তুল মোকাররকম মসজিদ পরিচালনায় বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি টাকা খরচ হয়। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে মসজিদের ব্যয় হয়েছে পাঁচ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ফান্ড থেকে ব্যয় হয়েছে ৪ কোটি টাকা, সরকারি অনুদান ১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। জাতীয় যে কোনও বিষয় বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। মসজিদ হিসেবে স্বাভাবিকভাবে মুসল্লিদের জন্য ওজু, নামাজের সুন্দর ব্যবস্থা থাকা জরুরি। একই সঙ্গে বহ্যিকভাবে অবকাঠামোও আকর্ষণীয় থাকা উচিত। কিন্তু জাতীয় মসজিদের চারপাশে মার্কেট করা হয়েছে। মার্কেটের যন্ত্রণা মসজিদকে ঘিরে ধরেছে। মসজিদ এমনিতেই মানুষের কাছে ভিন্ন গুরুত্ব বহন করে। জাতীয় মসজিদ হিসেবে এটির গুরুত্ব আরও বেশি। তাই এ মসজিদকে ঘিরে যত অবস্থাপনা রয়েছে তা দূর করা দরকার। সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে অবকাঠামোর উন্নয়ন প্রয়োজন। মসজিদকে ঘিরে যে বাণিজ্য গড়ে উঠেছে তা বন্ধ করা দরকার। কিছু দিন আগে একজন প্রবীন ইউরোপ প্রবাসী বায়তুল মোকাররম মসজিদের নোংরা পরিবেশ নিয়ে ভিডিও করেছেন যা আমরা ইউটিউবে দেখেছি। মুসলিম দেশ বাংলাদেশের কথা শুনলে আন্তর্জাতিক মহল অবশ্যই ভাববে- এ দেশে মুসলিমদের বড় একটি জাতীয় মসজিদ থাকবে এবং বায়তুল মোকাররম মসজিদের নাম আন্তর্জাতিক মহলেরও অনেকের জানা। আগে এখানে বিদেশী অতিথিরা আসতেন। বায়তুল মোকাররম মসজিদ পরিদর্শনের জন্যই বহু দূর দেশ থেকে অনেকে আসতেন। অনেক বছর আগে ইউরোপ থেকে একজন নারী এসেছিলেন বায়তুল মোকাররম মসজিদ দেখার জন্য। এখন যদি বিদেশীরা এসে মসজিদের এই নোংরা পরিবেশ দেখেন তখন তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে কি নেতিবাচক ধারণা নেবেন না? জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে মুসলিম দেশ বাংলাদেশ অন্যতম স্থানে। কেন রাষ্ট্রীয়ভাবেই এরকম অবহেলা? আমাদের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের টয়লেট। আজ আছরের পরের চিত্র। কতটা কষ্টের এবং লজ্জার! অন্তত বিরাজমান অবস্থার মধ্যেও পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, জায়গায় জায়গায় জমাট ময়লা পানি দূর করা এবং হারপিক-ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করা ব্যবস্থা রাখতে বাধ্য হতেন তারা। উপদেষ্টা মহোদয় কিছুদিন আগে ভিজিট করেছেন এবং এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন; এটা ভালো। কিন্তু এখন যে অবস্থা আছে এর মধ্যেই পরিচ্ছন্নতার সচল প্রক্রিয়ার চালু রাখতে কোনো অসুবিধা তো নাই, দেখা যাচ্ছে না। ঢাকা শহরের ছোটখাটো কোন মসজিদের টয়লেট ব্যবস্থাপনাও সম্ভবত এতটা নোংরা না। আমরা দেশের বিভিন্ন মসজিদে নামাজ পড়ি গুলশান মহাখালী বনানী উত্তরা ধানমন্ডি'র মসজিদগুলো কতটা পরিপাটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। অথচ জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম মসজিদের কত বিশ্রী পরিবেশ! অতীতে আমরা বায়তুল মোকাররম মসজিদের এরকম বিশ্রী পরিবেশ দেখা যায়নি। শিশুকাল থেকে বায়তুল মোকাররম মসজিদে যাই। বর্তমান পরিবেশ মারাত্মক বিশ্রী। আমরা আশা করি, কর্তৃপক্ষ এখানে সুদৃষ্টি দেবে। পবিত্র কাবা শরিফের আদলে নির্মিত এ মসজিদটি সারাদেশের মুসল্লিদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। পর্যটন করপোরেশনের ওয়েব সাইটে বায়তুল মুকাররম প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের বিশিষ্ট শিল্পপতি লতিফ বাওয়ানি ও তার ভাতিজা ইয়াহিয়া বাওয়ানির উদ্যোগে এই মসজিদ নির্মাণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। আব্দুল লতিফ ইব্রাহিম বাওয়ানি প্রথম ঢাকায় বিপুল ধারণক্ষমতাসহ একটি গ্র্যান্ড মসজিদ নির্মাণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ১৯৫৯ সালে ‘বায়তুল মুকাররম মসজিদ সোসাইটি’ গঠনের মাধ্যমে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। পুরান ঢাকা ও নতুন ঢাকার মিলনস্থলে মসজিদটির জন্য জায়গা অধিগ্রহণ করা হয়। স্থানটি নগরীর প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র থেকেও ছিল কাছে। বিশিষ্ট স্থপতি টি আব্দুল হুসেন থারিয়ানিকে মসজিদ কমপ্লেক্সটির নকশার জন্য নিযুক্ত করা হয়। পুরো কমপ্লেক্স নকশার মধ্যে দোকান, অফিস, লাইব্রেরি ও গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, ৮ দশমিক ৩০ একর জায়গা জুড়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদ। ১৯৬০ সালে ২৭ জানুয়ারি বায়তুল মোকাররম মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ১৯৬৩ সালের ২৫ জানুয়ারি মসজিদটিতে নামাজ পড়া শুরু হয়। ১৯৮২ সালে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বায়তুল মোকাররম মসজিদকে জাতীয় মসজিদ হিসেবে ঘোষণা করেন।

আরও পড়ুন :