চট্রগ্রামে মেডিকেলে নতুন মেশিনের আশায় হৃদরোগীরা

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগ যেন এক অনিশ্চয়তার অধ্যায় রচনা করেছে। হাসপাতালের করিডোরজুড়ে প্রতিদিনই ছুটে চলেন রোগীরা—কারও হৃদযন্ত্রে ব্যথা, কারও স্বজনের উদ্বিগ্ন মুখ। অথচ, এ হাসপাতালের সবচেয়ে জরুরি যন্ত্রগুলোর একটি এনজিওগ্রাম মেশিন, অপ্রতুলতা আর দীর্ঘসূত্রিতার শিকার হয়ে বছরের পর বছর ধরে সংকটের মধ্যে চলছে। তিন বছর আগে, ২০২১ সালের শেষদিকে, একটি এনজিওগ্রাম মেশিন বিকল হয়ে যাওয়ার পর থেকেই চমেক হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগ আরও বেশি চাপে পড়ে। সরকার টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে অতিরিক্ত একটি মেশিন সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিলেও, সেটি চট্টগ্রামে এনে স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ৪০ লাখ টাকা বরাদ্দ না থাকায় পরিকল্পনাটি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ফলে গত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে একটিমাত্র এনজিওগ্রাম মেশিন দিয়েই চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যেতে হচ্ছে, যা চট্টগ্রাম বিভাগের কোটি মানুষের জন্য কার্যত অপ্রতুল।
২০২১ সালের শেষের দিকে চমেক হাসপাতালের একটি এনজিওগ্রাম মেশিনের পিকচার টিউব বিকল হয়ে পড়ে। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান জানিয়েছিল, এটি মেরামত করতে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা প্রয়োজন হতে পারে। এত বিশাল অঙ্কের অর্থের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি, ফলে মেশিনটি আর সচল করা সম্ভব হয়নি। হৃদরোগ বিভাগের চিকিৎসকরা বিপাকে পড়েছেন কারণ এনজিওগ্রাম, পেসমেকার স্থাপন কিংবা রিং বসানোর মতো জটিল চিকিৎসাগুলোর জন্য এনজিওগ্রাম মেশিন অপরিহার্য। একটি বিকল হয়ে যাওয়ায় কার্যত সেবা পেতে রোগীদের দীর্ঘ অপেক্ষার শিকার হতে হয়, অনেকে বাধ্য হয়ে বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান, যা ব্যয়বহুল ও অনেকের নাগালের বাইরে। ২০২২ সালে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চমেক হাসপাতালের সংকট নিরসনে টাঙ্গাইল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে থাকা প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি এনজিওগ্রাম মেশিন চট্টগ্রামে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও হৃদরোগীরা কিছুটা আশার আলো দেখতে পান। কিন্তু সেই আলো বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। মেশিনটি চট্টগ্রামে আনা ও স্থাপনের জন্য প্রয়োজন ছিল ৪০ লাখ টাকা। কিন্তু বরাদ্দ না থাকায় পুরো পরিকল্পনাটিই স্থগিত হয়ে যায়।
বরাদ্দ না পাওয়ায় চমেক হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগ একটিমাত্র এনজিওগ্রাম মেশিনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। বর্তমানে জাপানের শিমার্জু ব্র্যান্ডের একটি মাত্র মেশিন দিয়ে টেম্পোরারি পেসমেকার (টিপিএম), পার্মানেন্ট পেসমেকার (পিপিএম), এনজিওগ্রাম, পেরিফেরাল এনজিওগ্রাম এবং রিং স্থাপনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পন্ন করা হচ্ছে। কিন্তু বহু সংখ্যক রোগীর চাপ সামলাতে গিয়ে মেশিনটির ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এটি দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ ছিল। পরবর্তীতে সরবরাহকারী কোম্পানির প্রতিনিধিরা এসে পিকচার টিউব স্থাপন করে এটি সচল করেন। তবে চিকিৎসকরা শঙ্কিত—এই অতিরিক্ত চাপের ফলে মেশিনটি যেকোনো সময় সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যেতে পারে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দিন সময়ের কণ্ঠস্বর'কে জানিয়েছেন, তিন বছর হয়ে গেল, কিন্তু মেশিনটি আনার এবং স্থাপনের জন্য ৪০ লাখ টাকার বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। ফলে পুরো প্রক্রিয়াটি থমকে আছে।
এদিকে, চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার হৃদরোগী চমেক হাসপাতালে আসেন। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারত, সিঙ্গাপুর, ব্যাংককসহ বিভিন্ন দেশে যান। কিন্তু নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের একমাত্র ভরসা এই হাসপাতাল। কিন্তু একটি মেশিন দিয়ে এত বিশাল সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা কার্যত অসম্ভব। চট্টগ্রাম বিভাগের কোটি মানুষের জন্য মাত্র একটি এনজিওগ্রাম মেশিন যথেষ্ট নয়। হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের প্রধান ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. নূর উদ্দিন তারেক সময়ের কণ্ঠস্বর'কে বলেছেন, “আমাদের হৃদরোগ বিভাগের রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি। এই একটি মাত্র মেশিন দিয়ে আমরা কোনোভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু এটি দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়।”
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগ শুধু চট্টগ্রাম শহরের জন্য নয়, পুরো বিভাগ তথা দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা কেন্দ্র। কিন্তু তিন বছর ধরে নতুন মেশিন বসানোর প্রতিশ্রুতি শুধুই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ।
পটিয়া থেকে বাবার সঙ্গে চমেক হৃদরোগ বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা পটিয়া সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের ছাত্র জমির উদ্দিনের সাথে কথা হয় সময়ের কণ্ঠস্বরের সাথে। তিনি বলেন, "সরকার যদি দ্রুত বরাদ্দ নিশ্চিত করে, তাহলে আমার মত হাজারো হৃদরোগীর চিকিৎসা ব্যাহত হবে না। আমার মত যেসব দরিদ্র রোগী উন্নত চিকিৎসার অভাবে দিন পার করছেন, তাদের জন্য এই বরাদ্দ হতে পারে জীবন-মরণের প্রশ্ন।" তিনি আরও বলেন, "সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও দায়িত্বশীল মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি—চট্টগ্রামের হৃদরোগীদের দুর্ভোগ যেন দীর্ঘ না হয়, সেই ব্যবস্থা দ্রুত নেওয়া হোক। এই হাসপাতালের নীরব করিডোরে আর যেন অপেক্ষার দীর্ঘশ্বাস না থাকে, বরং ফিরে আসুক সুস্থতার নিশ্বাস!"